বুধবার, ২৫ Jun ২০২৫, ১১:১৯ পূর্বাহ্ন
বিপুল কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগের দুই মেয়র। ফাইল ছবি
দৈনিকবিডিনিউজ৩৬০ ডেস্ক : ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কম ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে সর্বত্র চলছে নানামুখী আলোচনা ও বিশ্লেষণ। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক মহল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও টিভি টকশো থেকে শুরু করে গতকাল রবিবার অফিস-আদালত, দোকানপাটসহ সব জায়গাতেই আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল ভোটারের খরা। এসব আলোচনায় কান পেতে কমন যে প্রশ্নটি সর্বাধিকবার কানে এসেছে, সেটি হলো—আওয়ামী লীগের ভোটাররাই গেল কই?
যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা কারণে বিএনপির কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের সিংহভাগ ভোট দিতে কেন্দ্রে না গেলেও ক্ষমতাসীনদের নেতা-কর্মী-সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও বিপুল অংশ কেন ভোট দিতে যাননি সেটিই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হয়ে খাড়া হয়েছে। এই প্রশ্ন উত্থাপনকারীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বেশির ভাগ ভোট দিতে গেলেও ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতির চিত্রটা এমন হতো না। কারণ স্বাভাবিক জরিপ মতেই দলভেদে ঢাকা সিটির মোট ভোটারের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের সমর্থক। তাছাড়া শনিবারের ভোটের ঘোষিত ফলাফলের হিসাব মতে, দুই সিটিতে আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থী এবার যে ভোট পেয়েছেন তা ২০১৫ সালে একই দলের বিজয়ী মেয়রদ্বয়ের প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে অনেক কম।
আওয়ামী লীগের সমর্থক ভোটারদেরও বিরাট অংশের ভোট দিতে কেন্দ্রে না যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. আলমগীরও। ইসি সচিব গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘অনাস্থার কারণে মানুষ ভোট দিতে যাননি, এটা আমার কাছে মনে হয়নি। অনাস্থার কারণে যদি ভোটে না যেতেন, তাহলে যারা সরকারি দল তাদের তো অন্তত ভোটে অনাস্থা নাই। তাদের যদি সব ভোটার ভোট দিতেন, তাহলেও তো এত কম ভোট পড়ত না। তার মানে হলো যারা সরকারকে সমর্থন করেন, তাদেরও অনেক ভোটার ভোট দিতে যাননি।
কম ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস এবং উত্তরে আতিকুল ইসলামের ভোটের আগে ২০ দিনের প্রচারণার সময় প্রতিটি স্থানে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী-সমর্থক বা লোকজনের সমাগম দেখা গেছে। কিন্তু প্রচারণা বা গণসংযোগকালের সেই সমাগমের প্রতিফলন দেখা যায়নি ভোটের দিন দুই সিটির কেন্দ্রগুলোতে। ভোট শেষে বিজয়ী দুই মেয়র তাপস ও আতিক নিজেও সেটি স্বীকার করেছেন।
ঢাকা দক্ষিণের নবনির্বাচিত মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস শনিবার ভোটগ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘আমরা গণসংযোগে যখন গিয়েছি আশা করেছিলাম যে আরো ভোটার উপস্থিতি থাকবে। কারণ যে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পেয়েছিলাম, তাতে আশা করেছিলাম সবাই এসে ভোট দেবেন।’ ভোটারের খরার কারণ ব্যাখ্যায় শেখ তাপস বলেন, ‘এক বছর আগেই একটা জাতীয় নির্বাচন হলো। ঐ নির্বাচনে সবার আগ্রহ থাকে। এখানে যেহেতু সরকার পরিবর্তনের কোনো বিষয় নেই আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন, এজন্য আগ্রহ কম হতে পারে। আবার ছুটির সময়ে অনেকে ঢাকা ও দেশের বাইরে যেতে পারেন।’ ঢাকা উত্তরে পুনর্নির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলামও ভোট শেষে ভোটারের উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়ে বলেছেন, ‘আরো ভোটার ভোট দিতে এলে ভালো হতো। তবে শুক্র ও শনিবার ছুটি থাকায় অনেকে ঢাকার বাইরে চলে গেছে, এটাই বাস্তবতা।
শুধু আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থীই নন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে দলটির সমর্থিত প্রার্থীদের প্রচারণায়ও কর্মী-সমর্থকদের সরগরম উপস্থিতি দেখা গেছে। এছাড়া কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদেরও কারও কারও প্রচারণায় ব্যাপক লোক সমাগম হতে দেখা যায়। কিন্তু দুই মেয়র প্রার্থীর পাশাপাশি দল সমর্থিত ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীরাও কেন কেন্দ্রে ভোটার আনতে পারলেন না কিংবা আনলেন না—সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র।
নির্বাচনের আগে প্রচার-প্রচারণায় প্রতিটি স্থানেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বিপুল সমাগম থাকলেও ভোটের দিন কেন্দ্রের দৃশ্যের সঙ্গে সেটির মিল না থাকার বিষয়ে অবশ্য কয়েক ধরনের বিশ্লেষণও রয়েছে। কারও মতে, শেখ তাপস বা আতিকুল ইসলাম যখন যেই এলাকায় প্রচারণায় গেছেন তখন সেখানে যত লোক জড়ো হয়েছেন তাদের সবাই কিন্তু ঐ এলাকার ভোটার নন। আবার জড়ো হওয়া সব লোক এক কেন্দ্রের ভোটারও নন। অনেক কেন্দ্রের ভোটাররা ঐ সময়ে দলীয় মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে গণসংযোগ করেছেন, কিংবা পথসভায় অংশ নিয়েছেন। কিন্তু ঐ লোকজন ভোটের দিন ভাগ হয়ে ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট দিতে গেছেন কিংবা দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে গণসংযোগের সময়ে জড়ো হওয়া লোকজনের হিসাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থক ভোটারের উপস্থিতির অঙ্ক মিলবে না।
আবার এমন মতও রয়েছে যে, প্রচারণার সময় একটি ওয়ার্ডে মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে স্থানীয় হাজার-হাজার লোকজনকে দেখা গেছে। জড়ো হওয়া সেই লোকজনের মধ্যে কয়েক হাজার নিশ্চয়ই স্থানীয়ভাবে ভোটার। ওয়ার্ডভেদে পাঁচ থেকে আটটি ভোটকেন্দ্র থাকে। যদি স্থানীয় ভোটার ও কেন্দ্রের সংখ্যা হিসাব করা হয়, তাহলেও গণসংযোগে জড়ো হওয়া ঐ কয়েক হাজার ভোটারের মধ্যে প্রতিটি কেন্দ্রে কয়েকশ ভোটারের ভোট দিতে যাওয়ার কথা। কিন্তু ভোটের দিন বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে আওয়ামী লীগ সমর্থক ভোটারদের উপস্থিতির সেই হার দেখা যায়নি। একইভাবে প্রতিটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থিত কিংবা বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীরাও দলীয় ভোটারদের সিংহভাগকেই ভোটকেন্দ্রে আনতে পারেননি কিংবা আনেননি।
কম ভোটারের উপস্থিতির বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে বলেছেন, ‘ভোটার উপস্থিত কম হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। টানা তিনদিন ছুটি, সে কারণে ঢাকার অনেক ভোটার গ্রামে চলে গেছে। বিএনপি শুরু থেকে নির্বাচন ও ইভিএম সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা করেছে। এজন্য ৮-১০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে। এছাড়া বিএনপি শুরু থেকেই বলেছে—তারা নির্বাচনকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নিয়েছে। ফলে জনগণের মধ্যে ধারণা জন্মেছে বিএনপি জয়লাভের জন্য নির্বাচন করছে না, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে না। সে কারণেও অনেক ভোটার ভোট দিতে উত্সাহ হারিয়ে ফেলেছে।
আর ভোটারের খরার ব্যাখ্যায় ইসি সচিব মো. আলমগীর এ-ও বলেছেন, ‘আমি গেলেও সমস্যা নাই, এ ধরনের একটা মনোভাব থেকে হয়তো অনেকেই ভোট দিতে যাননি। জনগণ ছুটি পেয়েছে, অনেকে ছুটি ভোগ করেছে। কেউ কেউ ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
ঢাকা সিটি নির্বাচনে ভোটের হার কম হওয়ার জন্য বিএনপিকে দায়ী করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক গতকাল বলেছেন, ‘এর কারণ বিএনপির নির্বাচনবিরোধী চরিত্র। নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই বিএনপির নেতারা ও তাদের প্রার্থীরা ভোটারদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার হয়, এমন ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।’ ভোটারদের আগ্রহী করতে ভবিষ্যতে ইভিএম নিয়ে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো এবং স্থানীয় নির্বাচনের সময় গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্তটিও পুনর্বিবেচনার ওপর জোর দেন নানক। ভোটের দিন ঢাকা মহানগরে গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকা ভোটারের কম উপস্থিতির একটি কারণ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুও।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা গতকাল এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি নৈরাশ্যজনকভাবে কম ছিল। নির্বাচনি প্রচারে যে উত্সাহ ও অংশগ্রহণ ছিল ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে সেটির প্রতিফলন ঘটেনি।
এসএস